আজ ৭ই চৈত্র, ১৪২৯ বঙ্গাব্দ, ২১শে মার্চ, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ

দুই মাস পর কবর থেকে মাদ্রাসা ছাত্রের লাশ উত্তোলন, মৃত্যু নিয়ে রহস্য!

কিশোরগঞ্জ প্রতিনিধি সাদেক মিয়া : ছাইদুর রহমান নাঈম, কটিয়াদী (কিশোরগঞ্জ) প্রতিনিধি: কিশোরগঞ্জের কটিয়াদীতে দাফনের দুই মাস পর আদালতের নির্দেশে ময়নাতদন্তের জন্য কবর থেকে মাদ্রাসা ছাত্রের লাশ উত্তোলন করা হয়েছে।

বুধবার (১৬ মার্চ) দুপুরে মুমুরদিয়া ইউনিয়নের কুড়িখাই নগরপাড়া গ্রাম থেকে শিশু মাহিদ (৮) এর লাশ তোলা হয়েছে। এসময় কটিয়াদী থানা পুলিশের সাথে উপস্থিত ছিলেন উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভুমি) নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. ইব্রাহিম,  ওসি তদন্ত মো. মাহফুজুর রহমান।

মৃতের পরিবার ও মামলার এজাহারে জানা যায়, মৃত মাহিদের বাবা থাকেন বিদেশে। তাদের এক ছেলে এক মেয়ে। মাহিদ সবার বড়। গত ২ জানুয়ারি ২২ ইং রোববার বিকালে শিশু মাহিদ’কে স্থানীয় শাহ সামছ উদ্দিন সাফিয়া খাতুন মাদ্রাসায় পাঠান তারা। বাড়ি থেকে মাদ্রাসার দুরত্ব আনুমানিক ৩ কিমি. হবে। মাহিদ ওই মাদ্রাসার আবাসিক ছাত্র।

পরদিন সোমবার ছেলের জন্য মাদ্রাসায় খাবার পাঠালে মাদ্রাসা থেকে বলা হয় মাহিদ মাদ্রাসায় আসেনি। এরপর শুরু হয় খোঁজাখুঁজি। সকাল সাড়ে নয়টার দিকে প্রতিবেশী রোশনা খাতুন বাড়িতে এসে জানান, শিশু মাহিদ ফাঁস লাগানো অবস্থায় আত্মহত্যা করে তার রান্নাঘরে ঝুলে আছে। খবর শুনে ছোটে যায় মাহিদের মা ও দাদি। শিশু মাহিদের ও রোশনা খাতুনের ঘর পাশাপাশি।

মাহিদের মা ইয়াসমিন ও দাদি কল্পনা আক্তার গিয়ে দেখেন, শিশু মাহিদের ঝুলন্ত লাশ। গলায় মাথার পাগড়ি ছিল। পা ছিল মাটিতে লাগানো। এমন অবস্থা দেখে চিৎকার দিয়ে বেহুশ হয়ে পড়েন শিশুর মা ও দাদি । পরে স্থানীয়রা ওইদিনই ময়না তদন্ত ছাড়াই লাশ দাফন করেন। পরে শিশুর পরিবার বেহুশ অবস্থা থেকে কিছুটা স্বাভাবিক হলে জানতে পারেন, লাশের শরীরে ফাঁসির কোন চিহ্ন ছিলনা। ঘার ছিল ভাঙ্গা । এতে তাদের পরিবারের সন্দেহ হয়। মাহিদকে হত্যা করে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে।

এ ঘটনায় শিশু মাহিদের দাদি কল্পনা আক্তার বাদি হয়ে ১৭/২/২২ ইং তারিখে কিশোরগঞ্জ ৫ নং আদালতে প্রতিবেশী রোশনা খাতুনসহ মোট ৫ জনকে আসামি করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। অন্য আসামিরা হলেন, মো. জয় (১৯), মল্লিক মিয়া (৪০), কালাম (৫৮) নজরুল শাহ (৪৫)।

পরে আদালত মামলাটি আমলে নিয়ে শিশুর লাশ কবর থেকে উত্তোলন করে ময়নাতদন্ত ও প্রতিবেদন দাখিলের জন্য ২৫ জানুয়ারী ২২ ইং তারিখে কটিয়াদী মডেল থানার ওসিকে আদেশ দেন।

মামলার বাদি ও শিশু মাহিদের দাদি কল্পনা আক্তার বলেন, ‘আমার সাথে দীর্ঘ দিন ধরে জমিজমা নিয়ে প্রতিবেশী রোশনা খাতুনের পরিবারের সাথে বিরোধ চলছিল। কয়েকবার সালিশ দরবার হলেও মিমাংসা হয়নি। এই বিরোধের জের ধরেই আমার নাতিকে তারা পরিকল্পিতভাবে হত্যা করে থাকতে পারে বলে ধারণা করছি। এর আগেও এই মহিলা দেবরের সন্তানকে হত্যার ঘটনায় করা মামলায় জেল খেটেছেন। তাদের বিরুদ্ধে আরো অনেক অভিযোগ রয়েছে। আমরা প্রতিনিয়ত হুমকি ধামকির মধ্যে আছি। পরিবার নিয়ে নিরাপত্তাহীনতা বোধ করছি। আমরা নিরাপত্তা চাই এবং ঘটনার সঠিক তদন্তের মাধ্যমে এর বিচার চাই।’

শিশু মাহিদের মা ইয়াসমিন বলেন, আমার সন্তান আত্মহত্যা করতে পারে না। তাকে কষ্ট দিয়ে হত্যা করা হয়েছে। আমি এর বিচার চাই।

মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষক মাওলানা শরিফুল ইসলাম মুঠোফোনে বলেন, ‘বৃহস্পতিবার দিন সকালে মাহিদের দাদা এসে ছুটি চেয়ে মাদ্রাসা থেকে নিয়ে যায়। এরপরে সে মাদ্রাসায় আসেনি। মাহিদের এমন মৃত্যুতে আমরাও মর্মাহত। ঘটনার সঠিক তদন্তের মাধ্যমে আমরাও বিচার চাই।’

সরেজমিনে গিয়ে অনুসন্ধান, এলাকাবাসী ও প্রত্যক্ষদর্শীদের সাথে কথা হয়। এলাকাবাসীর মধ্যে মিলন মিয়া, আবু তালিব, মো. হারিস মিয়াসহ অনেকেই জানান, ‘শিশু মাহিদের মৃত্যু স্বাভাবিক মনে হয়নি। ৮ বছরের এত ছোট শিশু ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করতে পারেনা। যে অবস্থায় তাকে পাওয়া গেছে তাতে তাদের ধারণা হয়, কেউ হত্যা করে তাকে ঝুলিয়ে রেখেছে হয়তো।

মঙ্গলবার ১৫ মার্চ সকালে রান্নাঘরটিতে গিয়ে দেখা যায়, যেখানে শিশু ঝুলছিল সেই ধরনা ও ঘরের টিনের বেড়া একদম পাশাপাশি। হাতে ধরার মতো দুরত্ব। বাঁচতে চেষ্টা করতে হলে এটি সহজেই ধরা যেত। মাটি থেকে ধরনার উচ্চতা খুব বেশি না। ফলে বিষয়টি রহস্যজনক বলেই এলাকাবাসীও বলছেন।

প্রত্যক্ষদর্শী প্রতিবেশী আব্দুল হকের স্ত্রী নাসিমা আক্তার বলেন, ‘ওই দিন ২ জানুয়ারী রবিবার সন্ধার কিছুক্ষণ পর শিশু মাহিদকে রোশনা খাতুনের বাড়ির পিছন দিক দিয়ে বাড়ির দিকে আসতে দেখছি। এসময় তার হাতে কাপড়ের ব্যাগ ও শরিলে জ্যাকেট পরা দেখতে পাই। পরে আর কিছুই দেখিনি।’

একই প্রতিবেশী আব্দুল হক (৫৫) বলেন, ‘রবিবার দিন গভীর রাতে কুকুরের শব্দ শুনে ঘুম ভেঙে যায়। উঠে দেখি দরজায় একটি কুকুর ধাক্কা দিচ্ছে বার বার। আমি বের হতেই আমার কাছে এসে বসে শুয়ে কি যেন ইশারা করছে। এবং খুব চাপাচাপি করছিল। অন্ধকার থাকায় আমি সামনে যেতে পারিনি। প্রতিদিন প্রতিবেশী রোশনা আক্তারের বসত ঘরের কনারে একটি বিদ্যুৎতের লাইট জ্বালানো থাকতো। কিন্তু ওই দিন রাতে লাইটটি বন্ধ ছিল। ফলে চারদিকে অন্ধকার ছিল। পরে আমি শুয়ে পড়ি আবার।’

আব্দুল হকসহ অনেকেই জানান, ওই দিন সন্ধার পর থেকে ওই রান্নাঘরে কাছের কোন লাইট জ্বালানো তাদের চোখে পড়েনি।

শিশু মাহিদকে দাফনের আগে গোসল করিয়েছেন আবু তালেব। তালেব বলেন, আমি বেশকিছু ফাঁসের লাশের গোসল করিয়েছি। কিন্তু এই শিশুর শরীর ও মুখ দেখে ফাঁস নিয়ে আত্মহত্যা করেছে এমনটি মনে হয়নি আমার। গলায় কোন দাগ ছিলনা। ঘারটি ভাঙা মনে হয়েছে। মাথায় আচরের একটি লাল দাগ দেখতে পাই।’

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে রোশনা খাতুন সকল অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে বলেন, ‘ওরা মাহিদের পরিবার খুব খারাপ প্রকৃতির মানুষ। তুচ্ছ বিষয় নিয়ে সবসময় আমাদের সাথে ঝগড়াঝাটি করে। জমিজমা নিয়েও আমাদের সাথে বিরোধ আছে। দরবার শালিস হলেও ওরা ওদের মতামতের বাহিরে কিছু বুঝতে চায়না৷ শিশু মাহিদকে প্রায় সময় তারা নির্যাতন করতো। এসব কারণে হয়তো আত্মহত্যা করে থাকতে পারে। আমিও তদন্তের মাধ্যমে বিচার চাই। আমাদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে। আমরা নির্দোষ।

পূর্বের শিশু হত্যাসহ একাধিক মামলার বিষয়ে জানতে চাইলে রোশনা খাতুন বলেন, একটি হত্যা মামলায় দুই মাসের মতো জেলে ছিলাম। এসব মামলা মিথ্যা ছিল।

কটিয়াদী মডেল থানার (ওসি তদন্ত) মাহফুজুর রহমান জানান, ‘আদালতের নির্দেশনায় লাশ তোলা হয়েছে। ময়নাতদন্তের রিপোর্ট আসলে মৃত্যুর প্রকৃত কারণ জানা যাবে।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

     More News Of This Category